সাপের মাথায় মনি আছে এই কথা শুনেন নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। হাত নেই পা নেই নিরীহ এক প্রাণির নাম সাপ। হাজারো প্রজাতির মধ্যে কিছু বিষাক্ত, আবার কিছু বিষহীন। মাংসাশী এই সরিসৃপ প্রাণিটি বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই পর্বে আমরা জানব সাপের বিষ কি, বিষাক্ত সাপ চেনার উপায়, কেন সাপের কামড়ে এতদ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মানুষ, সাপে কামড় দিলে করণীয়, এন্টিভ্যানম ভ্যাক্সিন কি কখন কোথায় দিতে হয় এবং সাপের বিষের গুরুত্ব ইত্যাদি। আশা করি শেষ অবধি সাথেই থাকবেন।
সাপের বিষ কি এর রাসায়নিক ব্যাখ্যা
সাপের বিষ মূলত এক ধরনের লালা জাতীয় পদার্থ, যাতে বিভিন্ন টক্সিক পদার্থ থাকে । যেমন : নিউরো টক্সিন সাইটোটক্সিন এবং হেমোটক্সিন। এছাড়াও সাপের বিষে কিছু বিশেষ ধরনের টক্সিন পাওয়া যায় যারমধ্যে রয়েছে কার্ডিওটক্সিন, মায়োটক্সিন ও নেফ্রোটক্সিন ইত্যাদি।
আবার রাসায়নিকভাবে সাপের বিষে জিংক সালফাইট নামক রাসায়নিক যৌগ পাওয়া যায়। সাধারণত সাপে কাটার পর রোগীকে অ্যান্টিভেনাম দিয়ে তা নিষ্ক্রিয় করা হয়।
বিষাক্ত সাপ চেনার উপায়
বিষাক্ত সাপের লম্বাটে বিষদাঁত থাকে। তারা কামড়ের সময় এই বিষদাঁত বসিয়ে দেয়। অন্যদিকে বিষহীন সাপের চোখের মণি গোলাকার হয়। এদের দাঁত থাকলেও বিষগ্রন্থি থাকে না।
বিষাক্ত সাপে কাটার উপসর্গ
যদি আপনাকে নিউরোটক্সিন বিষযুক্ত একটি বিষাক্ত সাপ কামড় দেয় তাহলে আপনি দংশন স্থানে ব্যাথা অনুভব করবেন না। কিন্তু মুহুর্তেই পক্ষাঘাত অনুভব করতে শুরু করবেন। আপনার চোখের পাতা ভারী হয়ে যাবে। মুখ নাড়াচাড়া করা সম্ভব হবে না। জিহবা নিস্তেজ হয়ে যাবে। ভোক্যাল কর্ড অচল হওয়াতে কথা বন্ধ হয়ে যাবে। হাত-পা প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারে। তবে দ্রুত এন্টিভেনম দিতে পারলে অনেকাংশেই মৃত্যহার কমানো যায়।
বাংলাদে্শে কয় প্রকারের বিষধর শাপ রয়েছে কোন সাপ সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত
বিবিসি বাংলা এর জরিপে বলা হয়েছে বাংলাদেশে ৮০টি প্রজাতির সাপ রয়েছে। সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক এমএ ফায়েজ এর উদৃতি দিয়ে বিবিসি বাংলা জানায় দেশে যেসব সাপ রয়েছে, তার মধ্যে সাত থেকে আট প্রজাতির অত্যন্ত বিষধর সাপের কামড়ে মানুষ বেশি মারা যায়। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. নায়া নায়া। এটি কোবরা বা গোখরা প্রজাতির সাপ।
২. নায়া কাউচিয়া। এটিও গোখরা প্রজাতির সাপ, স্থানীয়ভাবে একে জাতি সাপ বা জাত সাপও বলে থাকে।
৩. কিং কোবরা বা শঙ্খচূড়। একে রাজ গোখরাও বলা হয়।
৪. ক্রেইট বা শঙ্খিনী। অনেক সময় এই সাপকে শঙ্খিনী এবং শাঁকিনী সাপ নামেও ডাকা হয়।
৫. কালো নাইজার। এটিও শঙ্খিনী জাতের সাপ এবং বাংলাদেশে প্রচুর সংখ্যায় রয়েছে এই সাপ।
৬. চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার
৭. সবুজ বোড়া। সবুজ বোড়া বা গ্রিন ভাইপার সাপকে স্থানীয়ভাবে গাল টাউয়া সাপও বলে।
সাপের বিষে মানুষ মারা যায় কেন
মানব শরীরে বিষের মেকানিজম অত্যন্ত ভয়াবহ। চলুন জেনে নেই সাপের বিষ মানুষের শরীরে গেলে কি ঘটে, কেন আক্রান্ত ব্যাক্তি দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে?
সাপের বিষে এক বিশেষ ধরনের উপাদান(হেমাটক্সিন) থাকে, যা রক্তের কোলাজেন তৈরিতে বাধা দেয় এবং লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস করে৷ ফলে টিশ্যু অচল হয়ে যায়, হৃত পণ্ড ব্লক হয়ে শ্বষণতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এন্টিকোয়াগুলেট রিয়্যাকশনের কারণে রক্ত জমাট বাঁধতে না পেরে অনবরত পড়তে থাকে৷
নিউরোটক্সিন স্নায়ুতন্ত্রকে আঘাত করে। মস্তিষ্ক ও স্নায়ুকলায় সিগ্ন্যাল পাঠাতে পারে না। ফলে, ব্যথা এবং পক্ষাঘাত(Paralysis) সৃষ্টি করতে পারে।
অন্যদিকে বিষধর সাপের বিষে phosphodiesterase নামক এনজাইম থাকে যা রক্ত চাপ কমিয়ে দেয়। আবার প্রাণঘাতি নিউরোটক্সিন বিষ মানবদেহে খুব দ্রুত কাজ করে। এরা মূহুর্তের ভিতর রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে স্নায়ুকলা আক্রমণ করে। এতে কিছু সময়ের ভিতর মানুষ পেশী, হৃতপিণ্ড ও শ্বসন তন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ওষুধ শিল্পে সাপের বিষের গুরুত্ব ও বাণিজ্যিকীকরন কিভাবে করা হয়
সারা পৃথিবীতে প্রতি ৪ মিনিটে একজন ব্যাক্তি সাপের বিষে মারা গেলেও মানব সভ্যতায় এর গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। এই সাপের বিষকে বলা হয় তরল ডায়মন্ড।
সাপ শুধু প্রকৃতির ভারসাম্যই রক্ষা করে না, এর বিষ মানুষের নানা রোগ থেকে মুক্তি এনে দেয়। অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় সাপের বিষের ওষুধ অতুলনীয়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ‘ক্রোটেলাস হরিডাস’ নামক এক ধরনের স্মৃতিশক্তি বাড়িয়ে তোলার ওষুধ রয়েছে, যা র্যাটেল সাপের বিষ দিয়ে তৈরি। আরো আছে ‘ল্যাকেসিস’ নামক এক ধরনের ওষুধ, যা খেলে প্রচণ্ড মানসিক রোগীও নিরাময় লাভ করে। এ ওষুধটিও তৈরি হচ্ছে বিষধর সাপের বিষ থেকে। সাপটির নামানুসারেই ওষুধটির নাম রাখা হয়েছে ‘ল্যাকেসিস’।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর্থিক সহায়তায় ২০১৭ সালে অ্যান্টিভেনম তৈরির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়।
পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।
সাপের কামড় দিলে করণীয় বা সাপের কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ জানান সাপে দংশন করলে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। যেমন:
যা অবশ্যই করতে হবে
* যতদ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
* হাত বা পা ভাঙার পর যেমন করে শক্ত কিছু দিয়ে কাপড় দিয়ে হলকা করে বাধা হয়, ঠিক সেভাবে বাধুন।
* সাপে কাটা অংশ যতটা সম্ভব কম নড়াচড়া করুন কারণ পেশীর নড়াচড়া যত কম হবে, বিষ তত কম ছড়াবে।
যা ভুলেও করা যাবে না
* কোনভাবেই আতংকিত হওয়া যাবে না।
* ওঝা বা ঝাড়ফুঁকের অপেক্ষা করে সময় নষ্ট করা যাবে না।
* চিকিৎসার আগ পর্যন্ত কিছু খাওয়া উচিত না।
* আক্রান্ত স্থানে কোন মলম বা মালিশ লাগানো উচিত না।
* সাপে কাটা জায়গায় শক্ত করে না বাঁধা, কারণ রক্ত জমে গিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন।
* মুখ দিয়ে চুষা, আক্রান্ত স্থানে কার্বলিক এসিড দেওয়া, চুন মলম লাগানো যাবে না।
সাপে কাটার চিকিৎসা
সাপে কাটার প্রথম ও প্রধান চিকিৎসা হচ্ছে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। রোগী থেকে কিংবা প্রত্যক্ষদর্শীর থেকে শোনা সাপের বিবরণ দেওয়া। এতে চিকিৎসকের এন্টিভেনম দেওয়া সহজ হবে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিভেনম দেওয়া ছাড়া সাপে কাটার আর কোন চিকিৎসা নেই। ভুল করেও গুনিন, ওঝা কবিরাজের ঝাড় ফোক গাছের লতাপাতা মলম জাতীয় কোন জিনিস ব্যবহার করা যাবে না।
পরিসখ্যানে দেখা যায়, খুব অল্প সংখক সাপেই বিষাক্ত হয়। কিন্তু অনেক সময় বিষহীন সাপের দংশনেও আতঙ্কিত হয়ে রোগী হার্ট ফেইল করে মারা যায়। তাই বিষাক্ত অবিষাক্ত যাই হোক না কেন রোগীর মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা করুন এবং ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন কেননা আপনাদের ধারণা ভুল হতে পারে।
ধন্যবাদ। আপনার দিনটি শুভ হোক।।।
সাপে কামড়ানোর ছবি সাপে কামড়ানোর কত মিনিট পরে মৃত্যুঞ্জয় একবার বমি করল? সাপে কামড়ালে কি ইনজেকশন সাপে কামড়ানোর লক্ষণ চন্দ্রবোড়া সাপ কামড়ালে কি হয় সাপে কাটার ভ্যাকসিন এর নাম সাপের কামড়ের ঔষধ সাপে কামড়ালে করণীয় সাপে কামড়ালে কি হয় বিষধর সাপের তালিকা সাপের কামড়ের ভ্যাকসিন কোথায় পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের বিষাক্ত সাপ সাপের বিষ কোথায় থাকে বিষাক্ত সাপের কামড় চেনার উপায়