আনিকা (ছদ্মনাম) এর বয়স ১৪ বছর। নবম শ্রেনীতে পড়ে। পর্যাপ্ত পড়ালেখা করেও পরীক্ষায় ফলাফল আশানুরূপ হচ্ছে না তার। বাবা মা খুবই হতাশ। শিক্ষক বলেন আনিকাকে যখন পড়ানো হয় তখন ঠিকই পারে কিন্তু পরের দিন আর বলতে পারে না, স্মরণ শক্তি কম। তার শারীরিক বৃদ্ধি একটু বেশি। তার বাবা তাকে প্রতিদিনই খাবার নিয়ন্ত্রণ করতে বলেন শারীরিক বৃদ্ধি কমানোর জন্য। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। এ নিয়ে বাবা মা খুবই চিন্তিত। অবশেষে কোন উপায় না পেয়ে ডাক্তারের স্মরনাপন্ন হলেন। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা দিলেন। রিপোর্ট নিয়ে পরদিন ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার নিশ্চিত করলেন যে আনিকার থাইরয়েডের সমস্যা রয়েছে। আর তাই তার পড়ালেখা কম মনে থাকে বা ভুলে যান এবং তার শারীরিক বৃদ্ধি এত বেশী। এবার আসুন জেনে নিই থাইরয়েড কী, এর কী কী সমস্যা হতে পারে, লক্ষ্মণ কী, আর প্রতিকার করব কীভাবে।
থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণের ঘরোয়া উপায়। লক্ষণ ও প্রতিকার |
থাইরয়েড কি
থাইরয়েড হলো গলার দুই পাশে থাকা একটি বিশেষ গ্রন্থি যা শরীরের বেশ কয়েকটি বিপাকীয় প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রন্থির কাজ হল- আমাদের শরীরের কিছু অত্যাবশ্যকীয় হরমোন (থাইরয়েড হরমোন) উৎপাদন করা। শরীরের জন্য এ থাইরয়েড হরমোনের একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। নির্দিষ্ট মাত্রার থেকে কম বা বেশি হরমোন উৎপাদিত হলেই শরীরের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করে। তৈরি হয় নানারকম শারীরিক জটিলতা।
থাইরয়েড হরমোনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে স্নায়ুর পরিপক্বতা। এজন্য গর্ভাবস্থায় থাইরয়েড হরমোনের স্বল্পতায় গর্ভের বাচ্চা বুদ্ধিদীপ্ত হয় না। যেসব উদ্দীপনায় বিপাক ক্রিয়া বেড়ে যায় যেমন-যৌবনপ্রাপ্তি, গর্ভাবস্থা, শরীরবৃত্তীয় কোনো চাপ-ইত্যাদি কারণে থাইরয়েড গ্লান্ডের গঠনগত বা কার্যকারিতায় প্রভাব পড়তে পারে।
থাইরয়েড হরমোন কম উৎপন্ন হলে বলা হয় হাইপোথাইরয়েডিজম এবং বেশি উৎপন্ন হলে বলা হয় হাইপারথাইরয়েডিজম। থাইরয়েড হলে শরীরে কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। আপনার শরীরে যদি এসব লক্ষণের কোনোটা দেখতে পান, তবে বুঝবেন থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছেন।
থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে মূলত দুধরনের সমস্যা দেখা যায়-গঠনগত ও কার্যগত। এটা বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ পেতে পারে।
গঠনগত সমস্যায় থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যায় যেটাকে গয়টার বা গলগণ্ড বলা হয়; এছাড়া থাইরয়েড গ্লান্ডে গোটা হতে পারে যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রুপ নিতে পারে।
কার্যত সমস্যা দুই রকমের হয়ে থাকে, যা হলো থাইরয়েড গ্লান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতা বা হাইপারথায়রয়েডিজম এবং কার্যকারিতা হ্রাস বা হাইপোথায়রয়েডিজম। এছাড়া থাইরয়েড গ্লান্ডের প্রদাহ বা থাইরয়ডাইটিস হতে পারে।
হাইপারথাইরয়ডিজমের লক্ষণ: হাইপারথাইরয়ডিজম রোগে থাইরয়েড গ্লান্ড বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে পড়ে। থাইরয়েড গ্লান্ডের অতিরিক্ত কার্যকারিতার ফলে প্রচণ্ড গরম লাগা, হাত পা ঘামা, পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা হতে পারে। খাওয়ার রুচি স্বাভাবিক বা বেড়ে যাওয়ার সত্বেও ওজন কমে যেতে পারে।
হাইপোথায়রয়ডিজমের লক্ষণ : অবসাদগ্রস্ত হওয়া, ত্বক খসখসে হয়ে যায়, ক্ষুধা মন্দা, চুল পড়া। ওজন বেড়ে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, শীত শীত ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, রক্তচাপ বাড়া, মাসিকের সমস্যা ইত্যাদি। বন্ধ্যত্ব সমস্যা হতে পারে। গর্ভধারণকালে গর্ভপাত হতে পারে। কনজেনিটাল হাইপোথাইরয়ডিজমে শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ হয় না।
থাইরয়েড ক্যান্সার : থাইরয়েড গ্রন্থির কোনো অংশের কোষসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধি পেলে তাকে থায়রয়েড ক্যান্সার বলে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থি বা এর অংশবিশেষ ফুলে ওঠা মানেই ক্যান্সার নয়।
থাইরয়েড ক্যান্সারের লক্ষণগুল
গলার সম্মুখভাগে ফুলে ওঠা। ফোলা অংশটি বেশ শক্ত হয়। একটি বা একাধিক টিউমার হতে পারে। উভয় পাশে টিউমার হতে পারে, আশপাশের লিঙ্ক নোডগুলো ফুলে উঠতে পারে। ওজন কমে যায়। খাওয়ার রুচি কমে যেতে পারে। গলার স্বর মোটা বা ফ্যাসফেসে হতে পারে। তবে থাইরয়েড নোডিউল বা ক্যান্সার ছাড়াও গলার সামনে ফুলে উঠতে পারে। শ্বাসনালির ওপর চাপ সৃষ্টির ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। ক্যান্সার শনাক্ত হলে বা ক্যান্সার আছে এমন সন্দেহ হলে অতিদ্রুত নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ বা থাইরয়েড অপারেশনে পারদর্শী কোনো সার্জনের কাছে যেতে হবে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এর কোন স্থায়ী প্রতিকার নেই, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিয়মিত ওষুধ সেবন করে যেতে হবে। তবে কয়েকটি ঘরোয়া উপায় এবং খাদ্যাভ্যাস রয়েছে যা দিয়ে এই সমস্যা অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ রাখা যায়।
আপনার খাদ্যের মধ্যে সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন অন্তর্ভুক্ত করুন: সামুদ্রিক শাকসবজি যেমন ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বা সী উইড যার মধ্যে আয়োডিনের মতো ইলেক্ট্রোলাইট এবং পুষ্টি রয়েছে, সেটি থাইরয়েডকে নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে। হিজকি, কম্বু, নরি, সি উইড, আরেম, কম্বু, কেল্প, এর মত সামুদ্রিক শাকসবজিও আপনার থাইরয়েড নিয়ন্ত্রনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্য তালিকায় সামুদ্রিক মাছ রাখতে পারেন। এতে আয়োডিনের অভাব পূরণ হবে।
রান্না করা সবুজ শাকসবজি খান: সবুজ শাকসবজি যেমন কেল, ব্রাসেলস স্প্রাউট, ব্রোকলি এবং ফুলকপি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে কিন্তু আপনার যদি থাইরয়েডের সমস্যা থাকে তাহলে এগুলি কাঁচা খাবেন না। কারণ এই সবজিগুলিতে বড় পরিমাণে গিটোজেন থাকে যা খেলে থাইরয়েড কার্যকারিতা ব্যাহত হতে পারে।
ভিটামিন ডি: শরীরে ভিটামিন ডি কম থাকলে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই সমস্যার সমাধান করতে প্রতিদিন সূর্যালোকে দাঁড়ান। সকাল সকাল রোদে দাঁড়িয়ে ব্যায়াম করলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং শরীরে ক্যালসিয়াম তৈরি হয়। ব্যায়াম যেমন হাঁটলেও থাইরয়েড গ্রন্থি উদ্দীপিত হয়।
আপেল সিডার ভিনেগার: অ্যাপল সিডার ভিনেগার শরীরের অ্যাসিড-অ্যালক্যালিন ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি ওজন বৃদ্ধিতে বাধা দেয় এবং হরমোন উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রন করে। ১ গ্লাস গরম পানিতে মধু এবং ২ চামচ অ্যাপল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে প্রতিদিন পান করলে থাইরয়েডে উপকার পাওয়া যায়।
প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার: দেহ সুস্থ রাখতে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের জুড়ি নেই। থায়রয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা বাড়াতে দই খাওয়া যেতে পারে। দইয়ে আছে আয়োডিন এবং প্রোবায়োটিক যা থাইরয়েডের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে রাখে। এছাড়া ডিম, জিংক থাইরয়েডের কার্যকারিতার ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
যে সব খাবার এড়িয়ে চলবেন
অতিরিক্ত চিনির ব্যবহার আপনার থাইরয়েড সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই থাইরয়েড সমস্যা থেকে ভুগছেন যারা, তারা প্রক্রিয়াকৃত চিনি এড়িয়ে চলুন। যদি সম্ভব হয় তবে প্রাকৃতিক শর্করা সমৃদ্ধ খাবারগুলিও এড়িয়ে চলুন। গ্লুটেইন , শষ্য-জাতীয় খাবার যা আঁশ সমৃদ্ধ, কড়া ভাজা খাবার ও সয়া-ধর্মী খাবার একদমই খাবেন ন না।
সর্বোপরি, যেকোনো শারীরিক জটিলতাই মারাত্মক হতে পারে। তারমধ্যে হরমোনাল প্রব্লেমগুলো আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, ভুগান্তিকর এবং দীর্ঘস্থায়ী। তাই সমস্যার শুরুতেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সচেতন থাকুন। আপনার দিনটি শুভ হোক।
ধন্যবাদ