ব্রিটিশ একটা উইকলি সায়েন্টিফিক জার্নাল আছে যার নাম ন্যাচার(Nature)। এই জার্নালে আজ থেকে প্রায় কয়েক বছর আগে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার একটি অসাধারণ রিসার্স পেপার পাব্লিশ হয়। এবং সেই রিসার্স পেপারটা বেশ এমিউজিং। যারা রিসার্স করছিল সেই সায়েন্টিস্টরা তিনটি অপিনিয়ন দেয়। এক গ্রুপ বলে মানুষের যে ক্রমাগত বয়স বাড়ছে তা স্থিমিত করে রাখা প্রায় অসম্ভব। আরেকটা গ্রুপ বলল না স্তিমিত করে রাখা সম্ভব। এবং মোস্ট ইন্টারেস্টিং হচ্ছে হাতে গুনা কয়েকজন বিজ্ঞানি বললেন যে আচ্ছা আমরা কি এমন কিছু করতে পারি না যে মানুষের যে বয়স থাকবে তার থেকে কমিয়ে ফেলা যায়? সম্ভব কি না। এখন অনেকের মাথায় প্রশ্ন আসতে পারে যে বয়স কেমন করে পিছানো যায়।
বয়স
আমাদের বয়স হয় মূলত দুই ধরনের। যেমন-
১/ ক্রনোলজিক্যাল এইজ। এটা হচ্ছে আমরা যে ডেট এ জন্ম নিয়েছি তখন থেকেই ক্যালেন্ডার শুরু হয়ে গেছে এবং একদিন একদিন করে বয়স বাড়ছে। আর সেটাই হলো ক্রনোলজিক্যাল বয়স বা সাধারণ বয়স।
২/ বায়োলজিক্যাল এইজ। এটা হচ্ছে আমাদের দুটি জেনেটিক্যাল মার্কার রয়েছে।
১/ টেলোমিয়ার ও
২/ ডি এন এ মিথাইলেশন
এই দুইটার পরিমাণ ক্যালকুলেশন করে আমরা বলতে পারি জেনেটিক্যালি আমাদের বয়স কত।
খুব ইন্টারেস্টিং তাই না?🤪
তার মানে ক্যালেন্ডার বয়সের হিসেবে দিন যত বাড়ছে বয়সও তত বাড়ছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে বায়োলজিক্যাল যে বয়স আছে তা আমরা ঐ দুটি মার্কারের সাহায্যে হিসেব করতে পারি। সেটা কমতেও পারে আবার বাড়তেও পারে।
তারুণ্য কি?
এবার আসা যাক তারুণ্য কি? আপাত দৃষ্টিতে বলতে গেলে তারুণ্য হচ্ছে আমাদের শরীর তথা স্কিনের একটি অবস্থা যার সাহায্যে আমরা একটা মানুষ কতটা ফ্রেশ বা সজীব তা বুঝতে পারি। শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় যেটিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে কোলাজেন নামক প্রোটিন। কোলাজেন কিভাবে তা নিয়ন্ত্রণ করে তা জানতে পড়া চালিয়ে যান
বয়স কমানোর পরীক্ষা
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ এক বছর গবেষণা করে কয়েকটি মেডিসিন এর একটি ককটেল তৈরি করেন। তারা সেই ককটেলটি পুরো এক বছর মোট ৯ জন মানুষের মধ্যে প্রয়োগ করেন। এবং এক বছর পরে তারা যখন টেলোমিয়ার ও ডি এন এ মিথাইলেশন পরীক্ষা করেন তখন তারা অবাক হয়ে যান। কেন অবাক হয়ে ছিল বিশ্ব তা বলার আগে চলুন আরেকটা বিষয় শেয়ার করি। আর সেটা হলো সান্সক্রিম।
কেন সান্সক্রিম ব্যাবহার করবেন
আমরা যারা একটু স্বাস্থ্য সচেতন বা সৌন্দর্য সচেতন সবাই সান্সক্রিমের নাম শুনেছি। এটি আমাদের শরীরে সূর্যালোকের আল্ট্রাভায়োলেট বা "অতিবেগুনি রশ্মি এ" ও "অতিবেগুনি রশ্মি বি", যে দুটি উপাদান আমাদের স্কিনের এজিং প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে বা বাড়িয়ে দেয় তাদের প্রতিহত করে। এই কারণে আমাদের স্কিনের কোলাজেন তার তারুণ্য ধরে রাখতে পারে।
কোলাজেন কি
কোলাজেন জিনিসটা কি? কোলাজেন হচ্ছে এক প্রকারের প্রোটিন। আমাদের শরীরে যত প্রোটিন রয়েছে তার তিন ভাগের একভাগ হচ্ছে কোলাজেন। এই প্রোটিন আমাদের স্কিনের স্ট্রেন্থ বা ইলাস্টিসিটি নিয়ন্ত্রণ করে। এই কারণে বয়স বাড়লে যে মানুষের স্কিন কণ্ডিশনটা খারাপ হয়ে যায় তার কারণ কোলাজেন ধ্বংস হয়ে যায়। এবং কোলাজেন যত দ্রুত ধ্বংস হয় বয়স বাড়ার পক্রিয়া তত দ্রুত বেড়ে যায়। যেটা আমাদের জন্য খুব ভয়ংকর। সান্সক্রিম ব্যাবহার করেও বয়স কমানো যায়।
কোলাজেন এর রুপান্তর |
আমরা চাচ্ছি কিভাবে আমাদের বয়সটাকে তুলনামূলক স্তিমিত করে রাখা যায়। এটা আমরা করতে পারি এই ক্রিম ব্যবহার করে। আমরা যদি সান্সক্রিম ব্যাবহার করি তাহলে তা আমাদের স্কিনের কোলাজের নষ্ট হওয়ার হার কমিয়ে দেয় এবং একই সাথে দেখা যায় আমাদের স্কিনের স্ট্রেন্থ আর ইলাস্টিসিটি নিয়ন্ত্রণ করে।
বয়স হ্রাসে ইদুর এক্সপেরিমেন্ট
১৯৩০ সালের দিকে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি যেটাকে আমরা সবাই এমআইটি নামে চিনি, সেখানকার একদল বিজ্ঞানি ইদুর নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। সেখানে ইদুরদের দুইটা ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। একভাগের ইদুরকে ঠিক যত পরিমাণ অর্থাৎ খাদ্যের যতটুকু চাহিদা আছে ততটুকুই খাবার দেওয়া হলো। আরেক গ্রুপের ইদুরদের তাদের চাহিদার ৫০% খাদ্য দেওয়া হলো। এভাবে ৩ থেকে ৪ মাস খাওয়ানোর পরে দেখা গিয়েছে যাদেরকে চাহিদার ৫০% বা অর্ধেক খাবার দেওয়া হয়েছে তদের আয়ুস্কাল ৫০% বেড়ে গিয়েছে পাশাপাশি তাদের এজিং বা বয়স বাড়ার প্রক্রিয়া ৫০% কমে গিয়েছে। এই গবেষণা থেজে বিজ্ঞানিরা ধারণা দেন যে, আমাদের যতটুকু খাওয়ার প্রয়োজন তার থেকে আমরা যদি একটু কম খাই, তাহলে আমাদের বয়স বাড়ার যে প্রক্রিয়া সেটি স্তিমিত হয়ে যাবে এবং আয়ুস্কাল বাড়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে আমরা যে রোযা রাখি সেটাতে অসাধারণ ফলাফলের সম্বাবনা রয়েছে। সেটি হচ্ছে আমাদের শরীরে যে খারাপ কোষ রয়েছে সেগুলো ধ্বংস হওয়ার মাধ্যমে আয়ুস্কাল বাড়িয়ে এইজিং প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
ধুমপান বয়স বাড়ায়
এখনে একটা জিনিস আছে। সেটি হচ্ছে আমরা ভয়ংকর একটা খারাপ কাজের সাথে জড়িত থাকি। সেটি হলো ধুমপান। এই ধুমপানে আমাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত যত ব্লাড ভ্যাসেল আছে বা যত রক্ত নালী আছে সেগুলো সরু হয়ে যায়। সিগারেটে যে মারাত্মক উপাদান রয়েছে সেটির নাম নিকোটিন। নিকোটিন করে কি? রক্তের নালীগুলোকে সরু করে দেয়। আর রক্তের নালী যখন সরু হয়ে যায় তখন ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়, ডায়বেটিস চলে আসে এবং একই সাথে আমাদের বয়স বাড়ার প্রক্রিয়াটা গতিশীল হয়ে যায়। যেটা ভয়ংকর খারাপ।
তারুণ্য ধরে রাখতে করণীয়
এখন যদি আমরা তারুণ্য ধরে রাখতে চাই তাহলে আমাদেরকে সেই ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানীরা যে গবেষণা করেছিল সেদিকে নজর দিতে হবে। তারা ককটেল বানিয়ে ৯ জনের শরীরে প্রয়োগ করেছিল। আর সেই গবেষণার রেজাল্ট দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গেছিল বিশ্ব। কারন বিজ্ঞান বলছে টেলোমিয়ার ছোট হওয়ার সাথে সাথে আয়ু কমে যায়। তারা দেখতে পেল তাদের তৈরি মেডিসিনের ককটেইল এক বছর খাওয়ানোর পর যাদের খাওয়ানো হয়েছিল তাদের বায়োলজিক্যাল বয়স ২.৫ বছর বা আড়াই বছর কমে গেছে। অর্থাৎ মোটের উপর এক বছরে ৩.৫ বছর সাড়ে তিন বছর কমে গেছে। তার মানে পুরো ধারণাই পালটে গেল। যেখানে পৃথিবীর মানুষ বয়স স্তিমিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে সেখানে তারা বয়সকে কমিয়ে ফেলতে সক্ষম হলো। মেডিসিন ককটেল এ তারা যে উপাদান ব্যাবহার করেছিল সেগুলোর মধ্যে ছিল-
- স্লিপিং বা ঘুম। আমরা যদি ঠিকভাবে ঘুমাতে পারি তাহলে দেখা যাবে আমাদের গ্রোথ হরমোনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ হবে এবং আমাদের টেলোমিয়ার হ্রাসের হার কমে যাবে।
- সান্সক্রিম। এ ব্যাপারে উপরে বিস্তারিত বলা হয়েছে।
- স্ট্রেস ফ্রি লাইফ বা মানিষিক চাপমুক্ত জীবন। এই সম্পর্কে বুঝতে গেলে ডক্টর মারিও মার্কিনিসের একটা বই আছে যার নাম "The mind body care"। সেখানে তিনি তিনটি কাজ করতে বলেছেন। যে তিনটি কাজ করলে বয়স বাড়ার যে প্রক্রিয়া তা ১৫ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে। কাজগুলো হলো-
- সহজে মাফ করে দেওয়া।
- সর্বদা কৃতজ্ঞতাপূর্ণ থাকা।
- লার্নি এর মধ্যে থাকা অর্থাৎ নতুন কিছু শিখার মধ্যে থাকা।
এখানে একটা বিষয় ক্লেয়ার করা দরকার আমরা যখন নামাজ পড়ি তখন সূরা ফাতেহা পাঠ করার মাধ্যমে আমরা কিন্তু কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি।
4. স্মোকিং বা ধুমপান থেকে বিরত থাকা। ধুমপানে থাকা নিকোটিনের কারণে হার্ট অ্যাটাক, লিভার, কিডনি ডিজিজ এমন কি মেমরি লসও হতে পারে।
বর্তমান সময়ে একটি জঘন্য কাজকে ধুমপানের চেয়েও মারাত্মক কল্পনা করা হয় সেটি হল ফিজিক্যাল ইন্যাক্টিভিটি বা শারীরিক নিস্ক্রিয়তা।
5. ব্যালেন্স ডায়েট বা পরিমিত আহার। ব্যালান্স ডায়েট বলতে আমাদের সুষম খাদ্যের যে ৬ টি উপাদান আছে তার প্রত্যেকটি পরিমান মত খাদ্যতালিকায় রাখা। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসগুলো খেয়াল করতে হবে তা হলো - পানি, কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার হেলদি ফ্যাট বা চর্বি গ্রহণ করে। কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে- মাংস, ডিম, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, টফু, কটেজ চিজ, মাছ, দুধ ইত্যাদি।
6. জয়ফুল পার্টনার। এটি আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ আমরা যদি হাসিখুশি থাকি তাহলে আমাদের বডিতে একধরনের হরমোন ও এনজাইম নিঃসৃত হয় যেটা কোলাজেন এর স্বাস্থ্য ভাল রাখতে বিশেষ ভুমিকা রাখে। তাই সদা সর্বদা নিজে হাস্যোজ্জ্বল থাকা এবং হাস্যোজ্জ্বল পার্টনারের সঙ্গ লাভ করা জরুরি। বেদনা বা বিষাদ আমাদেরকে দ্রুত বুড়ো বানিয়ে দেয়।
সর্বোপরি যেহেতু এটি একটি ন্যাচারাল প্রক্রিয়া তাই একে সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ বা থামিয়ে রাখা সম্ভব না। তবে বিজ্ঞান বলছে কিছু বিষয় মেইনটেইন করমে তা কিছুটা শিথিল করা সম্ভব।
ধন্যবাদ
লিখেছেন বাংলাদেশের তরুণ গবেষক ও জনপ্রিয় লেকচারার ড. নাবিল আলাম স্যার (বিসিএস স্বাস্থ্য)।
ড. নাবিল |
[প্রিয় পাঠক, আপনিও এসোজানি ওয়েভসাইটের অংশ হয়ে উঠুন। লাইফস্টাইল, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ, নারী, বিজ্ঞান, ধর্ম, পরামর্শ, স্মৃতিকথা, খাবার, রূপচর্চা ও ঘরোয়া টিপসহ জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো বিষয় নিয়ে লিখুন এবং মেইল করুন- esojani.info@gmail.com এই ঠিকানায়। আপনার লেখা পরিচয় ও ছবি সহ আমাদের ওয়েবসাইট এ প্রকাশ করা হবে।