তালাক একজন মানুষের দাম্পত্য জীবনের নিকৃষ্ট অধিকার। রাসুল সাঃ বলেন দুইটি নিগৃহীত বৈধ কাজ হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি ও তলাক। (আল হাদিস).
তালাক একটি অভিশাপের নাম |
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তালাকের ক্ষমতা কি নারী- পুরুষ সবার সমান? নারী কি চাইলেই তালাক দিতে পারে? কিংবা যদিই বা পারে তবে তার ইসলামি ও আইনি ভিত্তি কতটুকু? কোন কোন কারণে একজন নারী তালাক চাওয়ার অধিকার রাখে? আজ আমরা এসব ব্যাপারে সংক্ষিপ্তভাবে জানার চেষ্টা করব। তো চলুন মূল আলোচনায় চলে যাওয়া যাক। |
*স্ত্রী কি স্বামীকে তালাক দিতে পারে?
প্রথম কথা হচ্ছে, বিয়ের কাবীননামায় স্পষ্ট করেই নারীর ভরণপোষণ ও তালাকের এক্তিয়ার পুরুষদের উপর বর্তায়। তাই একজন পুরুষ চাইলে যেকোনো সময় তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে তাকে কিছু নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ মান্য করতে হয়। কিন্তু একজন স্ত্রী চাইলেই স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। বরং শর্ত সাপেক্ষে স্বামীর কাছে কিংবা আদালতের কাছে তালাক চাইতে পারে। এবং উপর্যুক্ত কারণ দর্শানোর মাধ্যমে সে তালাকপ্রাপ্ত হওয়ার অধিকার রাখে।
*কোন কারণে কখন স্ত্রী তালাক চাইতে পারে
ইসলামি শরিয়তের বিধানানুযায়ী শর্তসাপেক্ষে স্ত্রী তার স্বামীর কাছে কিংবা আদালতের কাছে তালাক চাইতে পারে। এটি তার রাষ্ট্রীয় অধিকারও বটে। বাংলাদেশে প্রচলিত Dissolution of Muslim Marriages Act, 1939 বা মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯ অনুসারে নিন্মলিখিত ক্ষেত্রে একজন স্ত্রী তালাক প্রাপ্ত হওয়ার জন্য আদালতের ডিক্রি পেতে পারে যেমনঃ
১/ স্বামী নিখোঁজ হলে
কোন কারণে স্বামী কমপক্ষে চার বছর নিরুদ্দেশ থাকলে স্ত্রী আদালতের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আদালত স্বামীর ওয়ারিশগণের স্বাক্ষী শুনে তারপর ডিক্রি প্রদান করে। তবে শর্ত থাকে যে, এই ডিক্রি কমপক্ষে ছয় মাস অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর হবে না। আবার কোন কারণে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্বামী নিজে বা কোন প্রতিনিধির মাধ্যমে যদি আদালতে প্রমাণ করতে পারে যে, সে তার স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে প্রস্তুত এবং সক্ষম সেক্ষেত্রে উক্ত ডিক্রি বাতিল বলে গণ্য হবে।
২/ স্বামী ভরণপোষণে ব্যার্থ হলে
কোন কারণে যদি স্বামী কমপক্ষে দুই বছর তার সামাজিক মর্যাদা অনুসারে স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে ব্যার্থ হয় তবে স্ত্রী তালাক চাইতে পারে। তবে শর্ত থাকে যে, কোন কারণ দর্শানো ব্যাতিরেকে স্ত্রী যদি স্বামী সহবাস থেকে বিরত থাকে তবে স্বামী তার ভরনপোষণ করতে বাধ্য নয়। আবার মনে রাখতে হবে, স্ত্রী যদি তলবি মোহরানা আদায়ের দাবীতে এমন আচরণ করেও তবে স্বামী তার ভরনপোষণ করতে বাধ্য থাকিবে।
৩/ স্বামী পুণরায় বিয়ে করলে
স্বামী যদি দেশের প্রচলিত আইন এবং মুসলিম বিবাহ আইন অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে পুনরায় বিয়ে করে তবে স্ত্রী তালাক চাইতে পারে।
৪/ স্বামীর জেল-হাযত হলে
স্বামী যদি কোন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আটক হওয়ার পর সাক্ষ্য প্রমাণে আদালত কর্তৃক অভিযুক্ত হয় এবং কমপক্ষে সাত বছর বা তার অধিক সাজাপ্রাপ্ত হয়, তবে স্ত্রী আদালতের কাছে তালাক চাইতে পারে। কিন্তু কারাদণ্ড চুড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন ডিক্রি দেওয়া যাবে না।
৫/ স্বামী দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যার্থ হলে
স্বামী কোনোরকম যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া একটানা তিন বছর বা তার অধিক সংসারের দায়-দায়ীত্ব পালনে ব্যার্থ হলে, উক্ত কারণ দর্শানোর মাধ্যমে স্ত্রী তালাক চাইতে পারে।
বিয়ের সুন্নত তরিকা, শুরু থেকে শেষ | সবার জানা জরুরি
৬/ স্বামী নপুংসক হলে
বিয়ের সময় যদি স্বামী নপুংসক হয় অর্থাৎ সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয় এবং এই অবস্থা চলতে থাকে তবে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে তালাক চাইতে পারে। কিন্তু স্বামী যদি আদালতকে এইমর্মে সন্তুষ্ট করতে পারেন যে তিনি তার শারীরিক অক্ষমতা থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন এবং এক বছরের মধ্যে প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি সন্তান জন্মদানে সক্ষম, তাহলে তালাকের মামলা খারিজ হয়ে যাবে।
৭/ স্বামী পাগল হলে
স্বামী যদি কমপক্ষে দুই বছর বা তার অধিক পাগল থাকে অথবা কুষ্ঠ রোগ বা দুরারোগ্য যৌন রোগে আক্রান্ত হয় তবে স্ত্রী তালাক চাইতে পারে।
৮/ স্ত্রীর বিয়ে অস্বীকার করার সুযোগ থাকলে
স্ত্রীর যদি ১৬ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে থাকে এবং ১৮ বছরের আগেই ঐ বিয়ে অস্বীকার করে তবে সে আদালতের মাধ্যমে তালাক চাইতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকলে এরকম মামলা দায়ের করা যাবে না।
৯/ স্বামী খুব নিষ্ঠুর হলে
স্বামী কোনো কারণে মাত্রাতিরিক্ত নিষ্ঠুর হলে এবং স্ত্রীর উপর অমানবিক নির্যাতন চালালে যাতে স্ত্রী শারীরিক মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয় যেমনঃ
- মারধোরঃ কারণে অকারণে স্ত্রীর উপর মারধর করলে।
- দুশ্চরিত্র নারীদের সাথে মেলামেশাঃ স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও স্বামী নষ্টা বা দুশ্চরিত্রা মহিলার সাথে মেলামেশা করলে।
- স্ত্রীকে অনৈতিক কাজে বাধ্যকরনঃ ব্যাক্তি ও সমাজজীবনে যেসব কাজ গর্হিত এবং অনৈতিক সেসব কাজ করতে স্ত্রীকে বাধ্য করলে।
- স্ত্রীর সম্পত্তির অপচয় ও আইনগত অধিকার প্রয়োগে বাধাঃ স্ত্রীর বিদ্যমান সম্পত্তির অপচয় করলে কিংবা স্ত্রীকে তার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে
- ধর্ম চর্চায় বাধাঃ স্ত্রীকে আপন আপন ধর্ম পালন করতে না দিলে।
- একাধিক স্ত্রী থাকলে কোরান-সুন্নাহ ভিত্তিক ভরনপোষণ না করাঃ একাধি স্ত্রী থাকলে স্ত্রীদের কোরআন সুন্নাহ এর আলোকে ব্যাবহার না করলে।
- তালাকে তাউফিজ থাকলেঃ তালাকে তাউফিজ হলো স্ত্রীকে দেওয়া এক বিশেষ অধিকার যে অধিকারবলে স্ত্রী যেকোন সময় তালাক দিতে পারে। উল্লেখ্য এটি স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত এক বিশেষ ক্ষমতা যা বিয়ের সময় কাবীন্নামায় উল্লেখ করার মাধ্যমে স্ত্রীকে প্রদান করা হয়।
*স্বামীকে তালাক দেওয়ার চার উপায়
বিয়ের আগে জরুরি সাস্থ্য পরীক্ষা; নারী পুরুষ সবার জন্য
১/ খুলার মাধ্যমে তালাক
খুলা হচ্ছে চুক্তিভিত্তিক তালাকের এক বিশেষ পদ্ধতি। যখন স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য তৈরি হয় কিংবা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয় এবং চরম আকার ধারন করে তখন স্ত্রী প্রতিদানের বিনিময়ে স্বামীর কাছে তালাক চাইতে পারে। এক্ষেত্রে সাধারণত দেনমোহরকেই বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। মোদ্দা কথা দেনমোহরের বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে তালাক নেওয়া। স্ত্রীর এরুপ প্রস্তাব স্বামী কর্তৃক অগ্রাহ্য হলে স্ত্রী আদালতের দারস্থ হতে পারেন। যেহাতু এরুপ তালাক স্ত্রী চেয়ে থাকেন তাই স্ত্রীকে চ্যায়ারমেন এর কাছে নোটিশ পাঠাতে হয়।
২/ মোবারতের মাধ্যমে তালাক
মোবারত খুলার মতই চুক্তিভিত্তিক বিবাহবিচ্ছেদ এর এক বিশেষ পদ্ধতি। যখন স্বামী স্ত্রী একে অপরের বিশ্বস্ততা হারায় এবং বিরুপ মনোভাব সৃষ্টি হয় তখন মোবারতের মাধ্যমে একে অপরকে তালাক দিতে পারে। তবে খুলা এককভিত্তিক তালাক পদ্ধতি হলেও মোবারতে উভয়ের সম্মতিতে তালাক কার্যকর হয়। এক্ষেত্রও চেয়ারম্যান এর নিকট নোটিশ পাঠাতে হয়। তবে স্বামী কিংবা স্ত্রী যিনি আগে তালাকের প্রস্তাব দিবেন তাকেই নোটিশ পাঠাতে হবে।
৩/ আদালতের মাধ্যমে তালাক
উপরে উল্লেখিত নয়টি কারণের যেকোন এক একাধিক কারণ সংঘটিত হলে অথবা রাষ্ট্র ও ইসলাম কর্ত্তৃক প্রদত্ত কোন কোন কারণ সাব্যস্ত হলে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে স্বামীকে তালাক দেওয়ার অনুমতি চাইতে পারে।
৪/ তালাকে তাউফিজের মাধ্যমে
তালাকে তাউফিজ হচ্ছে তালাকের এক বিশেষ পদ্ধতি। যে পদ্ধতির মাধ্যমে একজন নারী কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই তার স্বামীকে তালাক দিতে পারে। এটি এক বিশেষ অধিকার যা বিয়ের সময় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত হয় এবং বিয়ের কাবীননামায় সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়।
৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷ সমাপ্ত৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷৷
আরো পড়ুন-
কথায় কথায় ডিভোর্স/তালাক। কিন্তু কেন???
ধন্যবাদ। সুন্দর একটি পোস্ট। এ পোস্টিও পড়ে আসতে পারেন। স্বামীকে ডিভোর্স দেওয়ার নিয়ম - (আইনিভাবে ও ইসলামিক ভাবে)
উত্তরমুছুন