বিয়ের আগে জরুরি সাস্থ্য পরীক্ষা; নারী পুরুষ সবার জন্য

যারা বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন কেবল তাদের জন্য আজকের লেখাটি। আজ জানাব কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা সবার জানা জরুরি। কিছু রোগ আছে যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু বিয়ের পরে খুব সহজে স্বামী থেকে স্ত্রী, স্ত্রী থেকে স্বামীতে ছড়াতে পারে কিংবা তাদের সন্তানের মাঝে ছড়াতে পারে। একটু সচেতন হয়ে আগেই কিছু পরিক্ষা করালে রোগগুলো ধরা সম্ভব এবং চিকিৎসা করে সারিয়ে তোলা বা পরিবারের মাঝে বিস্তার রোধ করা সম্ভব।

premarital checkup blood group Syphilis Gonorrhoea যৌনবাহিত রোগ পরীক্ষা হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা থ্যালাসেমিয়া হেপাটাইটিস সি hiv বিয়ের আগে জরুরি সাস্থ্য


আজ আমরা জানব  মোট ৬ টি পরীক্ষার ব্যাপারে সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।

১/ থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা

থ্যালাসেমিয়া সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধযোগ্য। সিম্পল একটা রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেওয়া যায় সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না। বাবা মা এর কাছ থেকে এই রোগটি ছড়ায়। এমনকি বাবা মা এর থ্যালাসেমিয়া মাইনর(লক্ষন উপসর্গ না থাকা) থাকলেও সন্তানে ছড়াতে পারে এই জটিল রোগটি।

করণীয়ঃ বিয়ের আগে দুজনেই একটা রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। তাহলে তখনি ধরা পরবে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হতে পারে কি না। রক্ত পরীক্ষার নাম- HB Electrophoresis. একটা পরীক্ষায় দেড় হাজার টাকার মত পড়লেও ভবিষ্যত-এর লাখ লাখ টাকার কথা চিন্তা করলে এটা তেমন কিছু না।

আর পরীক্ষায় তিন ধরনের ফলাফল আসতে পারে। 

  • দুই জনের একজনেরও রক্তে কোন সমস্যা নেই। এমন ফলাফল আসলে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া নিয়ে কোন টেনশন নেই। 
  • দুই জনের মধ্যে একজনের থ্যালাসেমিয়া মাইনর। এক্ষেত্রে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই তবে নবাগত সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা ৫০%। অর্থাৎ বাচ্চা অসুস্থ হবে না তবে থ্যালাসেমিয়া এর বাহক হতে পারে।
  • দুই জনের থ্যালাসেমিয়া মাইনর ধরা পরা। এক্ষেত্রে বাচ্চার থ্যালাসেমিয়া নিয়া জন্মানোর সম্ভাবনা আছে এবং সেটা ২৫%, আর সাভাবিক সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%, আর বাকি ৫০% সম্ভাবনা থ্যালাসেমিয়া  মাইনর নিয়া জন্ম নেওয়া।

এই ধরনের ফলাফল আসলে হবু দম্পত্তিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা আদৌ বিয়ে করবেন কি না? করলে বাচ্চা নিবেন কি না কিংবা সুন্তান থ্যালাসেমিয়া  পজেটিভ হলে তাদের প্রস্তুতির আছে কি না ইত্যাদি।

২/ হেপাটাইটিস বি পরীক্ষা

হেপাটাইটিস বি একটা ভাইরাস যা আমাদের লিভারে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু যাদের শরীরে এই ভাইরাস থাকে তারা অনেকেই জানেন না যে তারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত। তাই নিজের অজান্তেই তারা অন্য মানুষের মাঝে ভাইরাসড়ি ছড়িয়ে থাকে। সুরক্ষা ছাড়া সহবাস করলে একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সহজেই এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।  তাই বিয়ের আগে দুজনেই এটি পরীক্ষা করে নেওয়া উচিৎ। এতে একজন আক্রান্ত হলে আরেকজনের মধ্যে যেন না ছড়ায় সেই সতর্কতাগুলো তখন নেওয়া যাবে। এর জন্য যে পরীক্ষাটি করতে হয়- HbsAg এবং Anti-HBC দুইজনের নেগেটিভ আসলে চিন্তার কোন কারণ নেই , তবে ভবিষ্যতে সুরক্ষিত থাকার জন্য টিকা নেওয়া জরুরু যদি আগে থেকে না নেওয়া থাকে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশে টিকা দেওয়া শুরি হয়। তাই আপনার জন্ম এর আগে হলে আলাদা করে টিকা নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। যদি একজনেরো পজেতিভ আসে সেক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসক আরো কিছু পরীক্ষা দিতে পারেন। এবং বিয়ের পর যেন এক জনের থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়াতে না পারে সে জন্য টিকা সহবাসের সময় কনডম ব্যাবহারসহ আর কি কি ব্যাবস্থা নেওয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে আপনার ডাক্তার আপনাকে পরামর্শ দিবেন।

অনেকেই মনে করতে পারেন এইটা মনে হয় যৌন রোগ। যেহেতু আমি আগে সহবাস করি নি তাই আম্র মধ্যে এটি থাকবে না। এটা ভুল ধারণা। সহবাস ছাড়াও আরো অনেকভাবে এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। যেমন

আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্তে, বীর্যে এবং সাদা স্রাব ইত্যাদিতে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে একই ব্লেড, রেজার এমনকি টুথব্রাশ, একই সুই, একই ইঞ্জেকশন ব্যবহার করলে, ডাক্তারের সরঞ্জমাদি, রক্তদান এমনকি জন্মের সময় মা থেকে শিশুতে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে।

৩/ হেপাটাইটিস সি পরীক্ষা

হেপাটাইটিস বি এর মতো হেপাটাইটিস সিও একটি  ভাইরাস যা লিভারের অনেক ক্ষতি করতে পারে। এটা ছড়ায় সাধারণত রক্তের মাধ্যমে। একই সুই বা ইঞ্জেকশন ব্যবহারের মাধ্যমে যাতে আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্ত থাকতে পারে, চিকিৎসার যন্ত্রপাতি জীবানূমুক্ত না হলে তার মাধ্যমে হেপাটাইটিস সি ছড়াতে পারে। এতে লিভার অনেকটুকু নষ্ট না হলে সাধারণত কোন লক্ষণ দেখা যায় না। অর্থাৎ অজান্তেই অনেকে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে। এবং অন্যদের মাঝে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। সুরক্ষা ছাড়া সহবাসের মাধ্যমে এবং মা থেকে সন্তানের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। যদিও এইভাবে ছড়ানোর সম্ভাবনা খুব কম। তবে কম হলেও যেহেতু সম্ভাবনা আছে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের মধ্যে এবং মা থেকে সন্তানের মধ্যে ছড়ানোর তাই পরীক্ষা করে নেওয়াই ভালো। এর জন্য Anti-HCV এই পরীক্ষাটা করে নিতে পারেন। খরচ পড়তে পারে এক থেকে দেড় হাজার টাকা। পজিটিভ আসলে আপনার চিকিৎসক আরো কিছু পরীক্ষা দিতে পারেন কনফার্ম হওয়ার জন্য এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করার জন্য। হেপাটাইটিস সি চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়ে যেতে পারে।

৪/ এইচ আইভি পরীক্ষা

এইচ আইভি সম্প্ররকে আমারা অঙ্কেই জানি। আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে সহবাসের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ায়। তবে আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে একই সুই বা ইঞ্জেকশন ব্যাবহার করলে, মা থেকে ছেলে তে এই ভাইরাস ছড়তাএ পারে। অনেকের ক্ষেত্রে বহু বৎসর এই ভাইরাসের কোন লক্ষণ প্রকাশ নাও থাকতে পারে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য এই পরীক্ষাটি করতে হয়- HIV ag/Ab আর এতে খরচ পড়তে পারে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা। পজিটিভ আসলে চিকিৎসার জন্য ওষুধ শুরু করতে পারবেন যা আপানার রক্তে ভাইরাসের পরিমাণ কমিয়ে আনবে। কয়েকমাসের মধ্যেভাইরাসের পরিমাণ এতটাই কমে যেতে পারে যে আপনি এটা কারো মধ্যে আর ছড়াতে পারবেন না।

৫/ যৌনবাহিত রোগ পরীক্ষা

অনেকেই যৌনবাহিত রোগে ভুগেন কিন্তু জানেন না। শুধু টেস্ট করার পরেই ধরা পরে। ফলে অনেকের যেহেতু কোন লক্ষণ থাকে না তাই টেস্ট করা হয় না চিকিতসাও হয় না। পরে নানাধরনের শারীরিক সমস্যা সহ সন্তান ধারণে সমস্যা দেখা দিতে পারে। অথচ সময়মতো অল্প কয়েকদিনের ড্রাগস নিলেই  রোগটা সেরে যেত। এই ৪ টি কম্ন যৌনবাহিত রোগ পরীক্ষা করতে পারেন-

  • Syphilis 
  • Gonorrhoea
  • Chlamydia
  • Tricho

রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসা করাতে পারবেন এবং সংক্রণ ঠেকাতে পারবেন।

৬/ রক্তের গ্রুপ

বিয়ের আগে রক্তের গ্রুপ জানতেই হবে এমন না। অনেকের একটা ধারণা আছে যে স্বামী-স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ একই হলে সুবিধা হতে পারে এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।

আমি এইখানে যতগুলো পরিক্ষার কথা বললাম, সবগুলোর  কারণ বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কেন বিয়ের আগে পরীক্ষাগুলো করা গুরুত্ত্বপূর্ণ। আরো ভাল হয় যদি দুজিন মিলে বিয়ের আগে একজন চিকিতসকের সাথে পরামর্শ করে নিলে। আপনাদের পরিবারে কি কি রোগ আছে, আপনাদের স্বাস্থ্য কেমন সেগুলো বিবেচনা করে তিনি আরো ভাল পরামর্শ দিতে পারবেন। আরেকটি বিশেষ কথা যে পরীক্ষাগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলোতে পজিটিভ হলেই যে বিয়ে করা যাবে না তা না। অনেকগুলো রোগের চিকিৎসা আছে একজন থেকে অন্যজনে যেন ছড়াতে না পারে সেজন্য অনেক ব্যাবস্থা আছে। এখানে শুধু কিছু তথ্য দেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়ীত্ব আপনার। 

                        (লেখাটি ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালইয়ের ছাত্র ও শিক্ষক তাসনিম জারা এর অনুকরণে লেখা)

AKMA

A Simple Man. Admin and Author of Esojani.com

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সাথেই থাকবেন, ইন শা আল্লাহ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন