এই কথা সবাই জানি যে, পশু কোরবানি করা মুসলমানদের জাতি পিতা হয্রত ইব্রাহীম (আঃ) এর সুন্নত ও স্বামর্থবানদের উপর ওয়াজিব। ইবাদতের সারকথা হলো আল্লাহতায়ালার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জন। আবার কোনো ইবাদতের কবুলের জন্য দুটি শর্ত জরুরি- ১/ ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আদায় করা ২/ শরিয়তের মাসআলা-মাসায়েল অনুযায়ী তা সম্পাদন করা।
বিভিন্ন পশু কোরবানির |
কোরবানির উদ্দেশ্য
মনে রাখতে হবে, কোরবানির মৌলিক উদ্দেশ্য কিন্তু পশু জবেহ করে শুধু রক্ত ঝরানো নয়। পবিত্র কোরআনে ক্বারিমে মহান
আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাষায় ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের কোরবানির পশুর রক্ত বা মাংস কোনটাই আল্লাহর
কাছে পৌঁছে না। আল্লাহর কাছে পৌঁছে তোমাদের হৃদয়ে প্রেমমাখা অনুভূতি ও খালেছ নিয়ত। (সূরা
হজ্ব, আয়াত : ৩৭)। তারপরো শরিয়তের প্রতিকী পশু কোরবানির বিধান দিয়েছে। যেন বনের
আড়ালে দেখাদেখি মনের পশুর গলায়ও মানুষ ছুরি চালিয়ে মানুষের ভেতরের পশুটাকে কতল করে একজন নিখাদ
ভালো মানুষ হয়ে ওঠতে পারেন।
কার উপর কুরবানী ওয়াজিব
১/ প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিস্কের কোন মুসলিম নর-নারী জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদেক থেকে ১২ তারিখ
সূর্যস্তের মধ্যে প্রাপ্তবয়ষ্ক, সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন ও সম্পদের দিক দিয়ে
নেসাবের মালিক হবে- তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব।
২/ অপ্রাপ্ত বয়ষ্কের কারো সম্পদ থাকলেও তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। পাগল ধনী হলেও তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়।
সম্পদের নেসাব
প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নর-নারীর কাছে টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাব করতে হবে। স্বর্ণের নিসাব হল সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি বা তার সমমূল্যের সম্পদ অথবা টাকা।(ইবনে মাজাহ ২২৬; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫
মনে রাখতে হবে, কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কোরবানির দিনগুলোয় থাকলেই তা ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬; রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২)। কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানী করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের ভিত্তিক ঋণ নিয়ে কুরবানী করা যাবে না।
১। নাবালেগ শিশু
নাবালেগ শিশু নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। কিন্তু তাদের অভিভাবকগণ তাদের সম্পদ দ্বারা নাবালেগ শিশুর পক্ষে কুরবানী করলে তা সহীহ হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬
২। মুসাফিরের জন্য কুরবানী
যে ব্যক্তি ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে কিংবা কুরবানীর দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। -ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৪, বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৫
৩। দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তির কুরবানীর হুকুম
দরিদ্র ও অসহায় ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়ত করে কোনো পশু ক্রয় করে তাহলে তার উপর ঐ পশু কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২
কোরবানির সঠিক সময়
১। প্রথম দিন কখন থেকে কোরবানি করা যাবে। যেসব এলাকার লোকদের উপর জুমা ও ঈদের নামায ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করা জায়েয নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামায না হয় তাহলে ঈদের নামাযের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কুরবানী করা জায়েয।-সহীহ বুখারী ২/৮৩২, কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮
২। রাতেও কোরবানী করা যায়। কোরবানির দিনগুলোর দিবাগত রাতেও কুরবানী করা জায়েয। তবে দিনে কুরবানী করাই ভালো। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৪৯২৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০, কাযীখান ৩/৩৪৫, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩
৩। কেউ যদি একান্তই নির্দিষ্ট সময়ে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। যদি পশু ক্রয় করে থাকে কিন্তু কোনো কারণবসত কুরবানী দেওয়া না হয়, তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিতে হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৪, ফাতাওয়া কাযীখান ৩/৩৪৫
কোরবানির পশুর বয়স
১। উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে।
২। গরু ও মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে।
৩। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে
হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি এক বছরের কিছু কম হলেও যদি এমন হৃষ্টপুষ্ট হয়
যে তা দেখতে এক বছরের মতো মনে হয় তাহলে সেটা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। কিন্তু ছয় মাসের কম হওয়া যাবে না। ছাগলেরর ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই এক বছরের কম হলে কোরবানি জায়েজ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬)।
কোরবানির শরিকানা
ছাগল, ভেড়া বা দুম্বার ক্ষেত্রে একটি দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারোটাই আদায় হবে না। তবে উট, গরু,
মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী
কবুল হবে না। -সহীহ মুসলিম ১৩১৮,
বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭-২০৮
গোশত খাওয়া কোরবানি দাতার জন্য বোনাস তথা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ দয়া। যদি কেউ আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ব্যতিত শুধু গোশত খাওয়া বা লোক-লজ্জার ভয়ে, সমাজ বজাতে কুরবানী করে তাহলে তার কুরবানী কোনক্রমেই সহীহ হবে না। এবং ঐ ধরনের অংশীদার বানালে শরীকদের কারো কুরবানী কবুল হবে না। শরীক নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাই অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮
উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে বা সাতের কমে যে কোনো সংখ্যা যেমন— দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কোরবানি করা জায়েজ। (সহিহ মুসলিম ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭) তবে সাতজন শরীকানা কোরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। নাহয় কোনো শরিকের কোরবানিই সহিহ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭।
কারোপক্ষে বা অন্য কারো ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে চাইলে ঐ ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। আর না হয় ঐ ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। মনে রাখতে হবে যে, কোন স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী/সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করে তাহলে তাদের কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।
অংশীধারী কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃত ব্যাক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দেয় তবে তা জায়েয হবে। নতুবা ঐ শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। কোন শরীকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কুরবানী কবুলহবে না।
মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করা যায়। যেমনিভাবে মৃতের পক্ষ থেকে ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানী করা জায়েয তদ্রূপ জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার ইসালে সওয়াবের জন্য নফল কুরবানী করা জায়েয। এ কুরবানীর গোশতও কোরবানিদাতা ও তার পরিবারও খেতে পারবে।
বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তির জন্য নিজ দেশে বা অন্য কোথাও কুরবানী করা জায়েয। তবে যে এলাকায় কোরবানি দিবে ঐ এলাকার বিধান মানতে হবে।
কুরবানীর পশু যদি চুরি হয়ে যায়, হারিয়ে যায় অথবা মরে যায় এবং মালিকের উপর কুরবানী ওয়াজিব থাকে তাহলে আরেকটি পশু
কুরবানী করতে হবে। যদি এমন হয় যে চুরি যাওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়া পশু ফিরে পায় তাহলে উভয় পশু কোরবানি দিতে হবে।
গরীব হলে বা যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয় এমন ব্যাক্তির পশু চুরি বা হারিয়ে গেলে তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানী করা ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬
কুরবানীর পশুতে আকীকার নিয়ম
কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।-তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩৬২
কোরবানির পশু জবাই এর নিয়ম
কুরবানীর পশু কোরবানিদাতা নিজেই জবাই দেওয়া উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই দেওয়া যেতে পারে। তবে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকা ভালো।
মুসনাদে আহমদ ২২৬৫৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২-২২
কোরবানির প্রস্তুতি |
কখনো যদি জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন না হয়, কসাই বা অন্য কারো সাহায্যের প্রয়োজন থাকে তবে উভয়কেই নিজ নিজ জবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তাহলে ঐ কুরবানী কবুল হবে না এবং জবাইকৃত পশুর গোশতও হালাল হবে না।
রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪
কোন কোন পশু কোরবানি দেওয়া যাবে
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া কোন পশু যেমন— হরিণ, বন্য গরু ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ নয়। যেসব পশু কোরবানি করা জায়েজ সেগুলোর নর-মাদা সবই কোরবানি করা যায়। (কাজিখান ৩/৩৪৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫)
কোরবানি কবুল হওয়ার শর্ত
সওয়াবের আশায় কোরবানি দেওয়া, কোরবানির অর্থ হালাল হওয়া এবং বিধানসম্মতভাবে কোরবানি দেওয়া।
শুধুমাত্র
গোশত খাওয়ার ইচ্ছায়, সামাজিক মান-মর্যাদা রক্ষায় কোরবানি দিলে তা কবুল হবে
না। কোরবানির অর্থ যদি হালালপন্থায় অর্জিত না হয়- তাহলে ওই কোরবানি
আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।
#কোরবানি#ঈদুল_আযাহা#qurbani
কোন পশু কিভাবে কোরবানি দিতে হয়-এর জন্য পড়ুন
কোরবানির পশুর গোশত ও চামড়ার বিধান-এর জন্য পড়ুন-
আরো পড়ুন-
কোরবানির বিধান | যে ভুলে কোরবানি হবে না
কোরবানির পশুর গোশত ও চামড়ার বিধান
বিয়ের সুন্নত তরিকা, শুরু থেকে শেষ | সবার জানা জরুরি
qurbnai 2021, qurbani in quran, is qurbani farz, benefits of qurbani in islam, rules of qurbani mentioned in quran, goat qurbani, qurbani for child, qurbani meat, কোরবানি সম্পর্কে হাদিস, কোরবানি সম্পর্কে কোরআনের আয়াত, কোরবানির নিয়ম, কোরবানি অর্থ কি, কোরবানির ইতিহাস, কোরবানি ২০২১, কোরবানির মাংস বন্টন হাদিস, কোরবানির গরু, qurbani 2022
good info
উত্তরমুছুনThanks. stay with us
মুছুন